Friday, February 7, 2014

" উদ্যোক্তা ও আবিষ্কারক ওয়াহিদের এগিয়ে চলা "

সৌরবিদু্যুৎ ব্যবহারকারীদের জন্য তিনি আবিষ্কার করেছেন ২৫ ওয়াট বিদ্যুতে চালিত একটি পাখা। এ আবিষ্কারটি ওয়াহিদের জীবনে এনে দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। সুগম করেছে কর্মসংস্থানের পথ।  ওয়াহিদের  আবিষ্কার ও সফলতা নিয়ে লিখেছেন শফিক বাশার 





ছোট্ট একটি ঘর। বেশ পরিপাটি। ঘরের এক পাশে বসার জায়গা, অন্য পাশে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি সংবলিত একটি ল্যাব। আপন মনে সেই ল্যাবে কাজ করছেন হালকা-পাতলা গড়নের একটি লোক। তার নাম ওয়াহিদুজ্জামান বাচ্চু। একই সঙ্গে তিনি আবিষ্কারক ও উদ্যোক্তা। ৩৬টিরও বেশি ছোট-বড় আবিষ্কারের অভিজ্ঞতা রয়েছে ওয়াহিদের। তার আবিষ্কৃত বেশ কয়েকটি পণ্য এরই মধ্যে বাজারজাত করা হয়েছে। বর্তমানে ওয়াহিদ সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের জন্য আবিষ্কার করেছেন ২৫ ওয়াট বিদ্যুতে চালিত একটি পাখা। এরই মধ্যে এ পাখা বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এ আবিষ্কারটি ওয়াহিদের জীবনে এনে দিয়েছে এক নতুন সম্ভাবনা। সুগম করেছে কর্মসংস্থানের পথ। এটিকে কেন্দ্র করেই ওয়াহিদ এগিয়ে যাচ্ছেন অর্থনৈতিক সচ্ছলতার দিকে।


ছোট্ট ল্যাবটিতেই কথা হয় ওয়াহিদের সঙ্গে। তিনি জানান, অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু খাতে দ্রুত উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। এমনই একটি খাত হচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ খাত। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় ৩০ লাখ গ্রাহক সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। কিন্তু এ বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের একটি বড় অংশই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে শুধু বাল্ব জ্বালাতে পারে। তারা বৈদ্যুতিক পাখা চালাতে পারে না বা সুযোগ পায় না। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, সৌরবিদ্যুতের সাহায্যে গ্রাহকরা সাধারণত ২০ থেকে ২০০ ওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সুবিধা পেয়ে থাকে। তবে খরচের কথা বিবেচনা করে বেশির ভাগ গ্রাহক ২০ থেকে ১০০ ওয়াট সৌরবিদ্যুৎ সুবিধা নিয়ে থাকে। স্বল্প পরিমাণ এ ওয়াট সুবিধায় আমাদের দেশীয় বাজারে প্রাপ্ত বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে তৈরিকৃত বৈদ্যুতিক পাখাগুলো চালানোর জন্য ৯০ থেকে ১০০ ওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। সুতরাং প্রয়োজন থাকলেও সৌরবিদ্যুতের গ্রাহকদের একটি বড় অংশই বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করতে পারে না। এ বিপুল পরিমাণ গ্রাহকের সুবিধার কথা চিন্তা করেই তিনি আবিষ্কার করেছেন ২৫ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ডিসি বৈদ্যুতিক পাখা। এরই মধ্যে তার আবিষ্কৃত পাখা বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে। বাজারজাতের কয়েক মাসের মধ্যে ২ হাজার পাখা বিক্রি হয়েছে বলে তিনি জানান। গ্রাহকদের অবস্থার কথা বিবেচনা করে এ পাখার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার টাকা। তিনি আরও জানান, আমাদের দেশে সৌরবিদ্যুৎ সম্প্রসারণের শুরুর দিকে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক পাখা চালানোর অনুমোদন ছিল না। সম্প্রতি ইডকল এ অনুমোদন দিয়েছে।

ওয়াহিদ জানান, সৌরবিদ্যুৎ এবং স্বল্প ওয়াটে চলা এ পাখা তৈরির জন্য শুধু পাখার মোটরটিই বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। মোটর ছাড়া বাকি সরঞ্জাম আমাদের দেশীয়। এ সরঞ্জামাদি তৈরির জন্য ১০ লাখ টাকা ব্যয় করে বিভিন্ন ধরনের মোল্ড তৈরি করা হয়েছে। পাখা তৈরির জন্য সোহবানবাগের তল্লাবাগ এলাকায় একটি কারখানা তৈরি করা হয়েছে। এ কারখানায় কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছেন। কীভাবে কারখানা দিলেনÑ এ প্রশ্নের জবাবে ওয়াহিদ জানান, আমার অর্থনৈতিক অবস্থার কথা তো আগেই বলেছি। একটি কারখানা দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ আমার ছিল না। অগ্রণী ব্যাংকের অনুদান পাওয়ার পর ২০১০ সালে সফলভাবে এ পাখাটি তৈরি করি। পাখাটি তৈরির পর বাজারজাত করার জন্য বিনিয়োগকারী খুঁজছিলাম। বেশ কয়েক জনের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর দুজন বিনিয়োগকারী এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের আর্থিক সহযোগিতায় একটি কোম্পানি গঠন করি। কোম্পানির নাম এসপিএল। বিডি বেঞ্চার আমাদের এ কোম্পানির ৪০ ভাগ শেয়ার কিনে নিয়েছে। এতে করে আপাতত কোম্পানিটির আর্থিক সমস্যা মিটেছে।

স্বল্প ওয়াটে চলা এ পাখা আবিষ্কারের জন্য ওয়াহিদকে অনেক কাঠখড়ি পোড়াতে হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে ওয়াহিদ যখন এ বিষয়ে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান তখন আর্থিক সঙ্কট প্রকট হয়ে দেখা দেয় তার। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় তার স্বপ্নের। অনেকের কাছেই আর্থিক সহযোগিতা চেয়ে ব্যর্থ হন তিনি। তবুও আশা ছাড়েননি ওয়াহিদ। শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারাকাতের কাছে একটি প্রস্তাবপত্র দিয়ে আর্থিক সহযোগিতা কামনা করেন ওয়াহিদ। তিনি প্রস্তাবটির সম্ভাবনা যাচাই করে কাজটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য ওয়াহিদকে ১ লাখ টাকা অনুদান প্রদান করেন। এ অনুদান ওয়াহিদের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে দেয়।

বৈদ্যুতিক পাখা ছাড়াও সৌরবিদ্যুতে চলার জন্য স্টিক লাইটও তৈরি করেছেন ওয়াহিদ। এ লাইট ৬ হাজার লুমেন আলো ছড়ায়। ঢাকা শহরের কাকরাইল থেকে নটর ডেম কলেজ পর্যন্ত এ ধরনের সৌরবিদ্যুৎ চালিত স্টিক লাইট লাগানো হয়েছে, যা বাইরে থেকে আনা হয়েছে। তার মতে, সারা দেশের রাস্তায় সৌরবিদ্যুৎ চালিত স্টিক লাইট ব্যবহার করতে পারলে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব হতো।

ওয়াহিদ স্বল্প বিদ্যুতে চলে এমন ক্ষমতাসম্পন্ন আরও একটি স্ট্যান্ড ফ্যান তৈরি করেছেন। তুলনামূলক অধিক বাতাস প্রদানকারী এ ফ্যান এসি-ডিসি দুই ব্যবস্থায় চলবে। বিজ্ঞান চর্চায় স্বশিক্ষিত ওয়াহিদ জানান, ছোটবেলা থেকেই আবিষ্কারের নেশা ছিল তার। বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় তার ছোট ছোট আবিষ্কার অনেককেই তাক লাগিয়ে দিত। এসব আবিষ্কারের জন্য অনেকের কাছ থেকেই পেয়েছেন উৎসাহ, যা তাকে পরবর্তী সময়ে কাজে আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করেছে। ওয়াহিদ ১৯৮৮ সালে জীবিকার সন্ধানে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় আসেন। তারপর বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করার ফাঁকে চালিয়ে যান বিজ্ঞান চর্চা। ব্যক্তিগত জীবনে তিন সন্তানের জনক ওয়াহিদ ভবিষ্যতে তার আবিষ্কারগুলো সাধারণ মানুষের উপকারে ছড়িয়ে দিতে চান। তিনি মনে করেন, তার উদ্যোগে এ সফলতা একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি আসবে, অন্যদিকে কর্মসংস্থান হবে হাজারো মানুষের।


No comments:

Post a Comment