প্রথম পণ্যটি এখনও বিক্রি হয়নি। তবুও হাল ছাড়েননি। হাজারো সীমাবদ্ধতার মাঝেও দেশী পণ্য নিয়ে সাজিয়েছেন মভ নামের দারুণ এক অনলাইন উদ্যোগ। নবীন এক সাহসী উদ্যোক্তার স্বপ্নের কথা জানাচ্ছেন তুহিন মাহমুদ।
পুঁজি স্বল্প হলেও ইচ্ছাশক্তি প্রবল। সেই জোরেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে পথে নেমেছেন। প্লাটফর্ম হিসাবে বেছে নিয়েছেন ফেইসবুককে। জনপ্রিয় এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটিও নিরাশ করেনি ঢাকার মেয়ে নুজহাত ফারহানাকে। নিজের ডিজাইনে তৈরি দেশীয় পণ্য বিক্রির উদ্যোগে এক বছরের মধ্যে আসতে শুরু করেছে সফলতা।
মভ (Mauve) নামের ফেইসবুকভিত্তিক বাণিজ্যক (এফ-কমার্স) সেবাটি আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। একই ছাদের নিচে দেশের সব জেলার ঐতিহ্যবাহী সব পণ্যের সমাহার তৈরিতে ফারহানার ব্যতিক্রমী উদ্যোগটি নজর কাড়ছে অনেকের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি মার্কেটিংয়ে বিবিএ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। তবে এ উদ্যোগের শুরু করেছেন আরও আগে। মভের মাধ্যমে নিজের তৈরি নকশার বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রির পাশাপাশি ছোটখাটো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজও করছেন।
উদ্যোগের পিছনের কথা
ছোটবেলা থেকে টুকিটাকি সৃজনশীল কাজে আগ্রহ ছিলো ফারহানার। নতুন ডিজাইনের কিছু তৈরিতে লেগে থাকতেন। আর ব্যবসা প্রশাসনের শিক্ষার্থী হওয়ায় স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন বুনেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। তার ভাবনায় ছিল দেশীয় ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র নিয়ে কাজ করার। দিনের পর দিন তিনি দেখেছেন, নিজের পণ্য ব্যবহারে সবাই কেমন যেন উদাসীন। দেশীয় পণ্যের কদরটা সবাই যেন ঠিকঠাক দেন না।
তাই একই ছাদের নিচে দেশের সব জেলার ঐতিহ্যবাহী সব পণ্য পাওয়া যাবে এমন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন বুনেছেন ফারহানা। নিজের সামর্থ্য ও বাস্তবতার কথা ভেবে বেছে নিলেন ফেইসবুককে। যাত্রার শুরুটা ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর।
শুরুটা যেভাবে
সমমনা কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে শুরুর ইচ্ছা ছিল ফারহানার। কিন্তু খুঁটিনাটি অনেক কিছু নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় শেষে জেদের বশে একাই মভের কাজ শুরু করেন। শোরুম বা ই-কমার্স সাইট তৈরির সঙ্গতি ছিল না। তাই ফেইসবুক পেইজকে বেছে নিলেন প্লাটফর্ম হিসাবে। তার ই-কমার্স বাণিজ্যের প্রথম পণ্যটি ছিল ক্রিস্টাল পুঁথির ব্যাগ। এরপর হাতে তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম, কাগজের তৈরি ক্র্যাফটসের পণ্য নিয়ে সাজাতে থাকেন তার পণ্য ভাণ্ডার।
প্রথম পণ্যটি এখনও বিক্রি হয়নি
অন্য নবীন উদ্যোক্তাদের মতো ফারহানার সৃষ্টি মভের চলার পথেও অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছে। ক্রিস্টালের ব্যাগটি পছন্দ হওয়ায় অনেক টাকা ব্যয়ে তা সংগ্রহ করেন। ভাবলেন সুন্দর এ ব্যাগের প্রতি সবাই আগ্রহী হবেন। কিন্তু প্রথম পণ্য নির্বাচনেই ছিল ভুল। সে ব্যাগটি আজও বিক্রি হয়নি।
প্রথম দিকে টিউশনির পুরো টাকা মভের পিছনে ব্যয় হয়েছে। অন্য কার্যক্রম চালানোর জন্য হাতে কিছুই থাকত না। অভিভাবকদের অনিচ্ছা স্বত্বেও পড়াশোনার পাশাপাশি অনেকটা জোর করেই ব্যবসা চালিয়ে গেছেন।
এ ছাড়া সঠিক সময়ে গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছানোও ছিল বড় প্রতিবন্ধকতা। এর সঙ্গে ফারহানাকে প্রায়ই একটা সমস্যায় প্রায়ই পড়তে হয়, সেটা হল জেন্ডার।
ব্যবসার প্রয়োজনে অনেক মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। কেউ কেউ এ যোগাযোগকে ইভটিজিংয়ে নামিয়ে আনেন। অনেকে মেয়ে বলে ডিসকারেজও করে। খুব টিপিক্যাল, অপমানজনক কথাবার্তা বলে। তারপরেও পিছিয়ে যেতে চান না তিনি।
মভের এগিয়ে চলা
প্রথমবারের পণ্যগুলো বিক্রি না হলেও, নুজহাত দমে যাননি। দ্বিগুণ উৎসাহে কাগজ দিয়ে হরেক রকম পণ্য তৈরি করেছেন। সবসময় যে খুব লাভ হয়েছে তা নয়, তবে তার মনের ক্ষুধা মিটেছে ষোলো আনাই।
মাঝে ‘রাংতা’ মেলায় শতরঞ্জি, কাগজের আইটেম, কিছু পাটের আইটেম এবং নিজের ডিজাইনে তৈরি কিছু পার্স নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন। কাগজের পণ্যের প্রতি এক ধরণের মুগ্ধতা খেয়াল করেন ক্রেতাদের মধ্যে। এটা অনেক আশাব্যাঞ্জক হিসেবে কাজ করে তার কাছে।
কাগজের কারিশমা
সম্প্রতি ওয়েডিং ডেকোরেশনের কাজ হাতে নিয়েছেন। এখানেও মূল উপাদান হিসাবে কাগজকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। মূলত কাগজ দিয়ে অরিগ্যামি, কিরিগ্যামি ও কুইলিং করা হয়। পেপার ক্র্যাফটসের আরও বিভিন্ন কারুকার্য ধীরে ধীরে রপ্ত করছেন।
বিদেশি কাগজ না কিনতে পারলেও দেশি কাগজ দিয়েই আপাতত সুন্দর কাজ চালানোর উপায় বের করেছেন। বর্তমানে চাইনিজ গহনাগাঠিও বিক্রি করছেন ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে।
চ্যালেঞ্জ যেখানে
গ্রাজুয়েশন শেষ হলে জেলাভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী পণ্য নিয়ে কাজ করতে চান নবীন এ উদ্যোক্তা। প্রথম বছরের তুলনায় মভের সাফল্য এখন ভালোই। তবে ঐতিহ্যবাহীর পণ্যের প্রতি ক্রেতাদের আকর্ষণের জায়গাটা এখনও তৈরি হয়নি বলে মনে করেন তিনি। এরপরও লেগে থাকতে চান এ কাজে। সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান দেশী পণ্যের জয়গান। এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হলেই তার স্বপ্ন রূপ পাবে বলে ফারহানার মন্তব্য।
প্রচারণা
আপাতত ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন। কিন্তু অন্যরা যেভাবে টাকা ব্যয় করে প্রচারণা চালায় সেটির কিছুই করেননি ফারহান। বাড়তি যা প্রচারণা সেটি ‘রাংতা’ মেলায় করেছেন। গ্রাজুয়েশনের পর প্রচারণার হাত দেবেন তিনি।
বিদেশের বাজার ধরার স্বপ্ন
তরুণ এ উদ্যোক্তার স্বপ্ন মভকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। তার পরিকল্পনা নিজস্ব একটি শোরুমের। যেখানে একজন ব্যক্তি একই ছাদের নিচে দেশের সব ইতিহ্যবাহী পণ্য খুঁজে পাবেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে একসময় মভের তৈরি দেশীয় পণ্য বিদেশের বাজারেও ক্যারিশমা দেখাবে এমন লক্ষ্য নিয়ে পথ চলছেন তিনি। নিজস্ব ডিজাইনে পোশাক তৈরির ইচ্ছাও রয়েছে।
নতুনদের জন্য পরামর্শ
বাজার ও ভোক্তা শ্রেণী নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি পাইকারী বাজার ও পণ্যের গুণগত মানের বিষয়ে জানতে হবে। এসব জেনে শুনে ব্যবসা শুরু করতে হবে। একই সঙ্গে পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা ও সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।
যোগাযোগ
ফেইসবুক পেইজ : www.facebook.com/mauve.bangladesh
ই-মেইল : mauve.bangladesh@yahoo.co
Source: http://techshohor.com/business/6031
No comments:
Post a Comment